
সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া মেগা ব্লকবাস্টার সায়েন্স ফিকশন জুরাসিক ওয়ার্ল্ড: ফলেন কিংডম মুভি দেখার পর দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুখে পড়তে হয়। মহাপ্রলয়ে হারিয়ে যাওয়া ডাইনোসরদেরকে আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনে কি প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব? নাকি এই ডাইনোসরেরাই পৃথিবীতে প্রাণীজগতের জন্য মহাপ্রলয় ডেকে আনবে? জুরাসিক পার্ক সিরিজের মুভিগুলো দেখলে মনে হয়, ডিএনএ ব্যবহার করে ডাইনোসরদেরকে পুনর্জন্ম দেয়া অসম্ভব কিছু না। কিন্তু এ ব্যাপারে বিজ্ঞান কী বলে?
মাইকেল ক্রিটনের রোমাঞ্চকর উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে ১৯৯৩ সালে নির্মিত জুরাসিক পার্কে দেখায়, বিজ্ঞানীরা অ্যাম্বারে আটকে পড়া মশার কাছ থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করেন। বাস্তবে প্যালেনটোলজিস্ট তথা ডাইনোসর বিশেষজ্ঞরা সত্যি সত্যিই অ্যাম্বারের মধ্যে বিভিন্ন পোকামাকড় এবং অন্যান্য অমেরুদণ্ডী প্রাণীর ডিএনএ খুঁজে পেয়েছেন। বিভিন্ন জীবাশ্মে ক্রিটেশিয়াস যুগের রক্তচোষা প্যারাসাইট টিকের ডিএনএ-ও পাওয়া যায়। ২০১৬ সালে প্যালেনটোলজিস্টরা অ্যাম্বারের মধ্যে মোটামুটি সুরক্ষিত অবস্থায় থাকা একটি ডাইনোসরের লেজ আবিষ্কার করেন। এমনকি তার চামড়া এবং পালকগুলোও প্রায় অক্ষত ছিল।

৪৮ মিলিয়ন বছর আগে পাওয়া হামিংবার্ডের পূর্বপুরুষের ফসিল © Robert Clarke
তবে এত কিছুর চিহ্ন পাওয়া গেলেও সম্পূর্ণ অক্ষত ডাইনোসরের ডিএনএর অস্ত্বিত্ব এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।নন অ্যাভিয়ান অর্থাৎ উড়তে না পারা ডাইনোসরেরা কোনো এক গ্রহাণু কিংবা উল্কার আঘাতে প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগেই বিলীন হয়ে গেছে। এত বছর আগের ধ্বংসাবশেষ থেকে টেকসই ডিএনএ তাই খুঁজে পাবার কথাও না। যুক্তরাজ্যের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের প্যালেনটোলজিস্ট সুজি মেইডমেন্ট বলেছেন, এখন পর্যন্ত ফসিলে পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো ডাইনোসরের ডিএনএটি মাত্র ১ মিলিয়ন বছর আগের। তাই হতাশ হয়ে বলতে হচ্ছে, সরাসরি ডিএনএ থেকে ডাইনোসরের পুনর্জন্ম দেওয়া অসম্ভব।

মন্টানায় খুঁজে পাওয়া টি-রেক্সের ফসিল ©nbcmontana
তবে পৃথিবীর ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনাবলী বর্ণনা করার জন্য ক্রনোলজিকাল ডেটিং সিস্টেম বা জিওলজিক টাইম স্কেল কিছুটা ভরসা দিচ্ছে। সুজির মতে, প্রোটিন এবং অন্যান্য সফট টিস্যু অক্ষত থাকার প্রমাণ মিলছে জিওলজিক টাইম স্কেল থেকে। তাই ভবিষ্যতে কখনোই ডাইনোসরের ফসিল থেকে ডিএনএ উদ্ধার করা সম্ভব হবে না, সেটা বলাটা ভুল হবে। দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অফ ডাইনোসরস বইয়ের লেখক স্টিভ বুসেট মজা করে বলেন, এই জিনিস আবিষ্কার করতে পারলে যে আমাদের কপাল খুলে যাবে, তা তো জানি। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও ডাইনোসর ক্লোন করার জন্য সম্পূর্ণ বা প্রায় সম্পূর্ণ জিনোম পাওয়া তো বহুদূর, অক্ষত ডিএনএ-ই কেউ খুঁজে পায়নি। যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির প্যালেনটোলজিস্ট মাইক বেনটনের মতে, ডিএনএ খুব তাড়াতাড়িই ভেঙে যায়। মাত্র কয়েকশো বছরের মধ্যেই এটি ভেঙে ক্ষুদ্র অর্থহীন খণ্ডে পরিণত হয়। অভাবনীয় কোনো টেকনোলজি ছাড়া সেই খণ্ডগুলোকে জোড়া লাগাবার কোনো উপায় নেই। সুতরাং আসল ডাইনোসরের ডিএনএ উদ্ধার করার আগে তাদের এই মিশন কুঁড়িতেই ঝরে যাচ্ছে।

এরকম প্রায় শতাধিক পাখির ফসিল পাওয়া গেছে © Robert Clarke
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গবেষক দল অবশ্য জিনোম এডিটিং টেকনোলজি এবং প্রাগৈতিহাসিক ডিএনএ সিকোয়েন্সের সাহায্যে বিলুপ্ত প্রাণীদের পুনর্জন্ম দেয়ার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে মিলিয়ন বছর তো দূরের কথা, মাত্র বিশ বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া প্রাণীকে পুনর্জন্ম দেওয়াটাও এখন পর্যন্ত বাস্তব রূপ পায়নি। তবে জিনোম এডিটিং টেকনোলজির ক্ষেত্রে নতুন সংযোজন CRISPR কিন্তু বিদ্যুতবেগে এগিয়ে চলেছে। এর পূর্ণরুপ হলো Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeats। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ভিডিও গেমভিত্তিক সায়েন্স ফিকশন মুভি র্যাম্পেজেও এর কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে ডিম্বাণু অবস্থাতেই ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর জেনেটিক খণ্ড সংমিশ্রণ করে তাদের বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করা হচ্ছে।

CRISPR টেকনোলজি ©Antonio Carusillo
কিন্তু তারপর? ধরে নিলাম, বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার না হওয়া টেকনোলজিকে হাতের নাগালে এনে নিখুঁত করে আধুনিক যুগের ডাইনোসরদের তৈরি করলেন। কিন্তু তারা কি আজকের পৃথিবীতে সবার সাথে মানিয়ে চলতে পারবে? বাঘ, সিংহ ভালুক, হায়েনাদের সাথে নতুন আরেকটি হিংস্র প্রাণী যোগ দিলে তা কি মানুষের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে? অবশ্য ক্রিটেশিয়াস যুগের বর্শার মতো কাঁটাওয়ালা কিন্তু নিরীহ তৃণভোজী অ্যানকিলোসরাস মানুষকে খুব একটা উৎপাত করবে না।

তৃণভোজী অ্যানকিলোসরাস ©Craig Shoji
তবে পেশীর শক্তি কম থাকলেও বুদ্ধির জোরে মানুষ ঠিকই এসব হিংস্র আর দুর্ধর্ষ প্রাণীদেরকে শিকার করে তাদের আবাসস্থল দখল করে নিচ্ছে। উল্টো এসব প্রাণীই এখন হুমকির মুখে। নেকড়ে কিংবা চিতার মতো প্রাণীদেরকেই মানুষেরা সহ্য করতে পারছে না। তাহলে একটা নেকড়ের সত্তর গুণ ওজনের একটা ডাইনোসরকে মেনে নেবে কী করে? তাছাড়া আধুনিক যুগের বিবর্তিত গাছপালা কিংবা জীবজন্তুর সাথে মানিয়ে নিতেও অসুবিধা হতে পারে প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরদের। এখনকার খাবার তাদের হজম হবে কি না, তা-ই বা কে জানে। অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সাথে তাদের কেমন সম্পর্ক হবে, সে ব্যাপারেও কিছু আন্দাজ করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে ফুড চেইনে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এই ডাইনোসরেরা কয়েকশ বছর আগের আবহাওয়ার সাথে বিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানের পৃথিবীতে জন্ম নিলে তারা নিজেদের গ্রহেই ভিনগ্রহবাসী হয়ে থাকবে, হয়তো কখনোই মানিয়ে নিতে পারবে না। তাই বিজ্ঞানীরা যদি আটতলা লম্বা টাইরানোসরাস রেক্সকে ফিরিয়ে আনেন, সেটা যে আমাদের বিপক্ষে যাবে এ নিয়েও মজা করেছে অনেকে।

ডাইনোসরদের কি ফিরিয়ে আনা উচিত? কখনোই না! ©Twitter
অবাক করা একটি তথ্য জানিয়েছেন স্টিভ বুসেট। প্রায় দশ হাজার প্রজাতির ডাইনোসর কিন্তু এখনো আমাদের আশেপাশেই আছে। আমরা তাদেরকে পাখি হিসেবে চিনি। প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে শক্তিশালী এক গ্রহাণুর আঘাতে যখন পৃথিবীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ জীব মারা যায়, তখন টিকে যায় এই পাখিদের পূর্বপুরুষেরা। বিবর্তনের ফলে পালকে ঘেরা কোমল এসব উডুক্কু প্রাণী কিন্তু প্রাগৈতিহাসিককালে বনেবাদাড়ে রাজত্ব করা দুর্ধর্ষ ডাইনোসরদেরই বংশধর। নিজেদের বুদ্ধির জোরে এবং পৃথিবীজুড়ে উপস্থিত ফার্ন আর পোকামাকড়ের ওপর জীবনধারণ করে এই ডাইনোসরগুলো টিকে যায়। ভেলোসিরেপ্টর নামক ডাইনোসরের সাথে চেহারা কিংবা আচরণ দুদিকেই ভালো মিল আছে ঈগল, উটপাখি, বনমোরগ, এমনকি রাজহাঁসেরও। আমরা তাই এক অর্থে ডাইনোসরদেরকে চিড়িয়াখানায় দেখছি, পালছি, এমনকি খাচ্ছিও।

প্রকৃতিবিদ ক্রিস প্যাকহ্যামের শো দ্য রিয়েল টি-রেক্স ©BBC
অনেকে অবশ্য বলেন, বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীগুলোকে পুনর্জন্ম দেবার চেষ্টাগুলো দারুণ। তবে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রায় বিলুপ্ত বা বিপন্ন প্রাণীদেরকে টিকে থাকতে সাহায্য করা। জাদুঘরে ডাইনোসরের ফসিলগুলো দেখে অতীতের কথা মনে করে আমাদের সাথে পৃথিবী ভাগাভাগি করা প্রাণীগুলোকে রক্ষা করার দিকেই তাই বেশি মনোযোগ দেয়া উচিত।