
হ্যারি পটার, ডক্টর হু, কিংবা গেম অব থ্রোন্স- এই চলচ্চিত্র এবং ধারাবাহিকগুলো যারাই দেখেছেন, তারা সবাই একটি দৃশ্যের সাথে মোটামুটি পরিচিত। বিশাল লাইব্রেরিতে হাজার হাজার বই, কিন্তু সবগুলোই লোহার শেকল দিয়ে শেলফের সাথে বাঁধা। সিনেমা কিংবা ধারাবাহিকের জগতগুলো অবশ্য কাল্পনিক। কিন্তু বাস্তবে সত্যি সত্যিই মধ্যযুগের ইউরোপে এ ধরনের লাইব্রেরির অস্তিত্ব ছিল, যার কয়েকটি এখনো টিকে আছে প্রায় অক্ষতভাবে।

গেম অব থ্রোন্সের সিটাডেল লাইব্রেরির শেকলে বাঁধা বই; Image Source: HBO
লিপিকারকরা সে সময় প্রতিটি বই অত্যন্ত যত্ন নিয়ে তৈরি করতো। মূল্যবান বিষয়বস্তুর বইগুলোর প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠায় তো বটেই, ভেতরের প্রতিটি অধ্যায়ের প্রথম পৃষ্ঠাগুলোতেও তারা রঙিন কালি দিয়ে জটিল নকশা করতো। সাথে থাকত প্রয়োজন অনুযায়ী হাতে তৈরি মানচিত্র, নকশা, অলঙ্করণ প্রভৃতি। বই লেখা সম্পন্ন হলে তা বাঁধাই করা হতো চামড়া দিয়ে। সেই চামড়াকে মজবুত করতে ব্যবহৃত হতো পিতলের পাত। কখনো কখনো স্বর্ণের কারুকাজও ব্যবহৃত হতো বইয়ে। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই এসব মহামূল্যবান বই সংরক্ষণ করা ছিল খুবই জরুরি।

লন্ডনের একটি লাইব্রেরির শেকলে বাঁধা বই; Image Source: carolineld.blogspot.in
পাশাপাশি অবস্থিত প্রতিটি বইয়ের গায়ে পৃথক পৃথক শেকল লাগানো থাকত। শেকলগুলোর দৈর্ঘ্য এমন হতো, যেন সেগুলো শেলফ থেকে নামিয়ে কয়েক পা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়া যায়। এর বেশি লম্বা হতো না, কারণ সেক্ষেত্রে পাঠকরা দূরে গিয়ে বসে আরাম করে পড়তে গেলে শেকলগুলো পরস্পরের সাথে পেঁচিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কেবলমাত্র প্রধান লাইব্রেরিয়ানই পারতেন চাবি দিয়ে শেকল খুলে কোনো বই তার নির্ধারিত স্থান থেকে বের করতে।

হিয়ারফোর্ড ক্যাথেড্রাল লাইব্রেরিতে উল্টো দিক ফিরিয়ে রাখা বই; Image Source: atlasobscura.com
এর একটা প্রায়োগিক কারণও ছিল। শৃঙ্খলিত বইয়ের শেকলগুলো তাদের স্পাইনের সাথে লাগানো থাকতো না, বরং লাগানো থাকত বইয়ের যেকোনো একপাশের মলাটের সাথে সংযুক্ত ধাতব পাতের সাথে। কারণ স্পাইনের সাথে লাগানো থাকলে প্রতিবার বই বের করার সময় মলাটের উপর পড়া অতিরিক্ত টানের ফলে বইগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়ার বা মলাট ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভবনা ছিল। একই কারণে বইগুলো বের করার সুবিধার জন্য স্পাইনগুলোকে পেছনে রেখে অপরপ্রান্ত পাঠকের দিকে রাখা হতো।

হিয়ারফোর্ড ক্যাথেড্রাল লাইব্রেরি; Image Source: atlasobscura.com
শৃঙ্খলিত লাইব্রেরির এ সংস্কৃতি চালু ছিল প্রায় অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। কিন্তু ধীরে ধীরে বই সহজলভ্য হয়ে উঠতে থাকায় এবং বই মুদ্রণের খরচ কমতে থাকায় এর প্রয়োজনীয়তা উঠে যায়। তারপরেও অনেক পুরনো লাইব্রেরিতে এখনও শেকলবিশিষ্ট বইয়ের দেখা পাওয়া যায়। ইউরোপ জুড়ে এরকম বেশ কিছু লাইব্রেরি আছে, যাদের মধ্যে কয়েকটি লাইব্রেরিতে বইগুলো তাদের সেই যুগের আসল শেকল এবং বুক শেলফসহ প্রায় সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত অবস্থায় সংরক্ষিত আছে।

লিব্রিজে চেইনড লাইব্রেরিতে টেবিলের উপর শেকলে আটকানো বই; Image Source: atlasobscura.com
চারশো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই লাইব্রেরিটিতে এখনও প্রায় ১,৫০০টি বই এবং প্রাচীন পাণ্ডুলিপি আছে, যার প্রতিটি শিকলে বাঁধা। বইগুলোর সাথে থাকা শেকল, রড, তালা এবং চাবিসহ লাইব্রেরির সকল আসবাবপত্র সে সময়ের। এর অধিকাংশ বই পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর সময়ের হলেও এতে ত্রয়োদশ শতাব্দীর পূর্বের বই এবং পাণ্ডুলিপিও আছে। এর সংগ্রহে থাকা সবচেয়ে পুরাতন বইটি ৭৮০ সালের।

লিব্রিজে চেইনড লাইব্রেরিতে চেইনে বাঁধা বইয়ের সামনেই বসার স্থান; Image Source: atlasobscura.com
এছাড়াও পঞ্চদশ শতকে প্রতিষ্ঠিত ইতালির বিবলিওটেকা ম্যালাটেসটিয়ানা লাইব্রেরিটিও এরকমই আরেকটি শৃঙ্খলিত লাইব্রেরি। শেকলে বাঁধা বইয়ের এই লাইব্রেরিগুলো মানবসভ্যতার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই প্রায়োগিক ব্যবহার না থাকলেও এগুলোর অনেকগুলোকেই নতুন করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, নেদারল্যান্ডসের লিব্রিজে চেইনড লাইব্রেরিটিকে বর্তমানে রূপ দেওয়া হয়েছে জাদুঘরে।

ধাতব রডের সাথে যেভাবে শেকল লাগানো থাকে; Image Source: atlasobscura.com
বর্তমান সময়ে যেখানে আমরা কয়েক ক্লিকেই বই ডাউনলোড করে ফেলতে পারছি, বা প্রি-অর্ডার করার মাধ্যমে কোনো বই প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই ঘরে বসেই তা পেয়ে যাচ্ছি, তখন আমাদের কাছে হয়ত শৃঙ্খলিত বইয়ের ধারণাটি অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু সে সময়ের বাস্তবতায় এটিই ছিল মূল্যবান বইকে চুরি কিংবা নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার গ্রহণযোগ্য একটি পদ্ধতি। অন্তত লাইব্রেরির ভেতরে খাঁচায় বন্দী অবস্থায় বই পড়ার পদ্ধতির সাথে তুলনা করলে এটি খুব বেশি অস্বাভাবিক পদ্ধতি ছিল না।