
আজকের লেখায় সেই গ্ল্যাডিয়েটরদেরই মৃত্যু সংক্রান্ত এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে, যা অধিকাংশ বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছেই এতদিন ছিলো অজানা। আর অজানাকে সবার সামনে তুলে ধরাই তো রোর বাংলার কাজ!
১
অ্যারেনার ভেতরে যুদ্ধ হতো গ্ল্যাডিয়েটরদের মাঝে। অধিকাংশ সময়ই তারা জোড়ায় জোড়ায় একে অপরের সাথে লড়াইয়ের লিপ্ত হতো। মাঝে মাঝে সেটা একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের যুদ্ধও ছিলো। কখনো কখনো প্রতিপক্ষকে একেবারে ধরাশয়ী করে তাকে প্রাণভিক্ষা চাওয়া পর্যন্ত গড়াতো যুদ্ধগুলো। এমন পরিস্থিতিতে কী ঘটতে যাচ্ছে তার ভাগ্যে, সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতো খেলা দেখতে আসা দর্শকবৃন্দ এবং সেই প্রদর্শনীর প্রধান, যাকে বলা হতো এডিটর।

Image Source: Quora
২
খেলার ফলাফল যা-ই হোক না কেন, একজন গ্ল্যাডিয়েটরের শেষ পরিণতি কী হবে এটা নির্ভর করতো অ্যারেনাতে তার কার্যাবলীর উপর।
ধরুন, একজন গ্ল্যাডিয়েটর প্রতিপক্ষের কাছে পরাজিত হলেন। কিন্তু মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি বীরের মতো লড়াই করলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে পালানোর কোনো চেষ্টা করলেন না, দেখালেন না দুর্বলতার সামান্যতম চিহ্নও- এমন একজনের মৃতদেহও সসম্মানে অ্যারেনা থেকে নিয়ে যাওয়া হতো। হেরে গেলেও সকলের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়েই থাকতেন তিনি।

Image Source: Ripley's Believe It or Not!
৩
এখন কেউ কেউ ভাবতে পারেন, কোনো গ্ল্যাডিয়েটর হয়তো অ্যারেনাতে মারা যাবার মিথ্যা অভিনয় করতে পারতেন। পরে তাকে টেনেহিচড়ে বাইরে নিয়ে গেলে সুযোগ বুঝে পালিয়ে গেলেই হয়ে যেতো!
এমনটা যে হতে পারতো, সেটা গ্ল্যাডিয়েটরদের মাঝে যুদ্ধের আয়োজকেরাও অনুমান করেছিলো। তাই এটা যেন কোনোভাবেই না হতে পারে, সেই ব্যবস্থাও তারা করে রেখেছিলেন।

Image Source: YouTube
আবার, যেসব গ্ল্যাডিয়েটর কাপুরুষের মতো অ্যারেনায় মারা যেত, তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে এরপর একজন ক্রীতদাসকে সেখানে পাঠানো হতো। তিনি সেখানে গিয়ে একটি বড় পাথরখণ্ড বা মুগুরের সাহায্যে ঐ মৃত গ্ল্যাডিয়েটরের মাথা পুরো থেঁতলে দিতেন!
অর্থাৎ, এখানে অভিনয়ের কোনো সুযোগই ছিলো না।
৪
একটু আগেই যে ক্রীতদাসদের কথা বলা হলো, তারাও একেক সময় একেক পোশাক পরিধান করতেন।

Image Source: Design Toscano
৫
প্রাচীন রোমে গ্ল্যাডিয়েটরদের মাঝে অধিকাংশই ছিলো বিভিন্ন যুদ্ধবন্দী, যাদেরকে ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিলো। অবশ্য স্বল্প সংখ্যক স্বাধীন মানুষও থাকতো তাদের মাঝে।

Image Source: NPR
তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের অ্যারেনাতে পাঠানোর আগে কোনোরকম প্রশিক্ষণই দেয়া হতো না। যত ভালোই মোকাবেলা করুক না কেন, মৃত্যুই ছিলো তাদের শেষ নিয়তি। তাদের রক্তই ছিলো উপস্থিত দর্শকদের বিনোদনের খোরাক।
৬
গ্ল্যাডিয়েটরদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে একটি অদ্ভুত জিনিস শেখানো হতো। সেটি হলো, কীভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়। খুব অদ্ভুত শোনালেও, এই সময়ে তাদের চাহনি এবং অঙ্গভঙ্গিই পারতো পুরো পরিস্থিতি বদলে দিতে।
ধরুন, দুজন গ্ল্যাডিয়েটরের মাঝে তুমুল লড়াই চলছে। এর মাঝে হঠাৎ করেই একজন তার প্রতিপক্ষকে এমন আঘাত করলো যে সেই লোকটি সাথে সাথে মাটিতে পড়ে গেলো, আর একটি মাত্র আঘাতই তার প্রাণপাখিকে মুক্ত করে দিতে যথেষ্ট। এমন পরিস্থিতিতে নিয়ম ছিল যে, দাঁড়িয়ে থাকা গ্ল্যাডিয়েটরকে মরণ আঘাত হানার আগে আয়োজকদের দিকে একটিবারের জন্য হলেও তাকাতে হতো। তখন আয়োজকরাই সিদ্ধান্ত নিতেন, পড়ে যাওয়া সেই গ্ল্যাডিয়েটরকে প্রাণ ভিক্ষা দেয়া হবে, নাকি সেখানেই মেরে ফেলা হবে।

Image Source: ipfactly.com
৭
গ্ল্যাডিয়েটরদের একটা বড় অংশই যে স্বেচ্ছায় এই পথে আসতেন না তা তো কিছুক্ষণ আগেই বলা হয়েছে। এর ফলস্বরুপ তাদের অনেকে এই জীবন-মরণ খেলায় অংশও নিতে চাইতেন না।
চতুর্থ শতকের রাজনীতিবিদ সিম্মাকাস একবার একটি প্রতিযোগিতার জন্য ২০ জন গ্ল্যাডিয়েটরকে সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু যখন অ্যারেনাতে তাদের প্রবেশের সময় হলো, তখন তারা পূর্বপরিকল্পনানুযায়ী একে অপরকে হত্যা করে ফেলেছিলো। এমন ঘটনায় উপস্থিত সকলেই হতবুদ্ধি হয়ে যায়।

Image Source: Realm of History
৮
একজন গ্ল্যাডিয়েটর যখন প্রতিপক্ষের আঘাতে মাটিতে পড়ে যেতো এবং যখন তার মৃত্যুও সেখানেই নিশ্চিত হয়ে যেত, তখন কখনও কখনও দেখা যেত যে, দর্শকদের মাঝে কেউ ছুটে সেই গ্ল্যাডিয়েটরের কাছে গিয়ে ক্ষতস্থান থেকে তার রক্ত পানে মত্ত হয়ে উঠেছে! কথাটি অদ্ভুত শোনালেও আসলেই এমনটা ঘটতো। আর এটা করতো মূলত মৃগীরোগীরা। কারণ তাদেরকে বলা হতো, যদি তারা একজন গ্ল্যাডিয়েটরের রক্ত পান করে, তবে তাদের এই রোগ চিরতরে সেরে যাবে।

Image Source: iStock
৯
গ্ল্যাডিয়েটরদের রক্ত যে শুধুমাত্র মৃগীরোগীরা ব্যবহার করতেন তা কিন্তু না। তাদের শারীরিক শক্তি অনেকের কাছেই তাদেরকে মডেলে পরিণত করেছিলো। বিভিন্ন ফুলদানী, মোজাইল ও দেয়ালচিত্রে তাদের দেখা মিলতো।

Image Source: Imgur
১০
অ্যারেনা থেকে একজন মৃত গ্ল্যাডিয়েটরকে কীভাবে নেয়া হবে সেটা তো আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এবার চলুন জানা যাক তাদের মৃতদেহের শেষ পরিণতি সম্পর্কে।
একজন গ্ল্যাডিয়েটর যদি বীরের মতো মৃত্যুবরণ করতেন, তবে তার মৃতদেহটি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাবার অনুমতি দেয়া হতো। শবদাহের পর বিভিন্ন উপহাস সামগ্রীর সাথে দেহের ভস্মটুকু মাটিচাপা দেয়া হতো।

Image Source: digitalvortex.info
তবে কাপুরুষের মতো মারা যাওয়া গ্ল্যাডিয়েটরদের মৃতদেহের ভাগ্যও ছিলো খারাপ। কোনো আত্মীয়স্বজন এসে দেহটি নিয়ে যাবার দাবি না জানালে কিছুদিন পর দেহটি নদীতে ফেলে দেয়া হতো কিংবা ভাগাড়ে ফেলে দেয়া হতো যাতে সেখানেই তা পচে যায়।