চাষাবাদ মানবজীবনের অপরিহার্য অংশ। এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশা। সূচনা থেকেই কৃষিকাজ বা চাষাবাদের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। চাষাবাদের ইতিহাস এত পুরনো, যত পুরনো এই পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাস। ইসলাম এই পেশাকে মর্যাদার চোখে দেখেছে। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) চাষাবাদ করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। আল্লামা সুরুখসি (রহ.) লিখেছেন, মহানবী (সা.) জারফ নামক স্থানে চাষাবাদ করেছেন। (আল-মাবসুত লিস সুরুখসি : ২/২৩) আল কোরআনে চাষাবাদের গুরুত্ব পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন স্থানে চাষাবাদের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এক আয়াতে এসেছে, ‘তিনিই (আল্লাহ) আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তা দিয়ে আমি সব ধরনের উদ্ভিদ উত্পন্ন করি; তারপর তা থেকে সবুজ ফসল নির্গত করি, যা থেকে ঘন শস্যদানা উত্পাদন করি এবং খেজুর বৃক্ষের মাথি থেকে ঝুলন্ত কাঁদি বের করি আর আঙুরের বাগান সৃষ্টি করি এবং জয়তুন ও আনারও। এরা একে অন্যের সদৃশ ও বিসদৃশ। লক্ষ করো তার ফলের প্রতি, যখন তা ফলবান হয় এবং তার পরিপক্বতার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করো। ঈমানদারদের জন্য এগুলোয় অবশ্যই নিদর্শন আছে। ’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৯৯) শুষ্ক বীজ ও শুষ্ক আঁটির ভেতর থেকে শ্যামল ও সতেজ বৃক্ষ বের করে দেওয়া একমাত্র জগত্স্রষ্টারই কাজ। এর মধ্যে মানুষের চেষ্টা ও কর্মের প্রভাব নেই। আল্লাহর কুদরতে বীজ ও আঁটির ভেতর থেকে যে নাজুক অঙ্কুর গজিয়ে ওঠে, তার বেড়ে ওঠার পথ থেকে প্রতিবন্ধক ও ক্ষতিকর বস্তু সরিয়ে দেওয়াই কৃষকের মূল চেষ্টার বিষয়। লাঙল চষে মাটি নরম করা, সার দেওয়া, পানি দেওয়া—এতটুকুই কৃষকের কাজ। আসল কাজ হচ্ছে বীজ ও আঁটি থেকে বৃক্ষের অঙ্কুরোদ্গম হওয়া, অতঃপর তাতে রংবেরংয়ের রকমারি পাতা গজানো এবং তা ফলে-ফুলে সুশোভিত হওয়া। এ ক্ষেত্রে মানবীয় কর্মের কোনো প্রভাব নেই। তাই অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা কি ওই বীজগুলো দেখো না, যা তোমরা মাটিতে ফেলে দাও? এগুলো থেকে তোমরা ফসল উত্পাদন করো, না আমি করি?’ (সুরা : ওয়াকিয়া, আয়াত : ৬৩-৬৪) কোরআনের অলৌকিকতা হলো, কোরআন চাষবাসের কথা বলছে, অথচ সেখানে ঐশী চেতনা জাগ্রত করতে চেয়েছে। কোরআনের বক্তব্য দেখুন : ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ করুক। আমিই প্রচুর বারি বর্ষণ করি। পরে আমি ভূমি প্রকৃষ্টরূপে বিদারিত করি এবং আমি তাতে উত্পন্ন করি শস্য, আঙুর, শাকসবজি, জাইতুন, খেজুর, বহু বৃক্ষবিশিষ্ট বাগান, ফল ও গবাদি খাদ্য। এটা তোমাদের ও তোমাদের জীবজন্তুর ভোগের জন্য। ’ (সুরা : আবাসা, আয়াত : ২৪-৩২ কোরআনের বিভিন্ন স্থানে বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির কিছু দৃশ্য মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে, যাতে এর বিচিত্র প্রকার, বর্ণ, গন্ধ ও সৌন্দর্য দেখে মানুষ পুলকিত হয়, অভিভূত হয়। যেন সব কিছুর উন্নতি, অগ্রগতি ও সক্রিয়তা দেখে মানুষ আল্লাহর কুদরতের কথা স্মরণ করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য তা (পানি) দিয়ে জন্মান শস্য, জাইতুন, খেজুরগাছ, আঙুর ও সব ধরনের ফল। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন। ’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১১) চাষাবাদের উপযোগী করে মহান আল্লাহ এই জমিনকে বহু আগেই সাজিয়ে রেখেছেন। কোরআন বলছে, ‘তুমি ভূমিকে দেখবে শুষ্ক। পরে আমি তাতে বারি বর্ষণ করলে তা শস্যশ্যামল হয়ে আন্দোলিত ও স্ফীত হয় এবং তা উদ্গত করে সব ধরনের নয়নাভিরাম উদ্ভিদ। ’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৫) মৃত ভূমিকে জীবিত করার জন্য মহান আল্লাহ সুদূর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। সেই পানি জমিনকে জীবিত করে তোলে। এই পুনর্জীবন পুনরুত্থানের প্রতীক। কোরআনের ভাষ্য দেখুন : ‘আকাশ থেকে আমি বর্ষণ করি কল্যাণকর বৃষ্টি। তা দিয়ে আমি সৃষ্টি করি বাগান ও পরিপক্ব শস্যরাজি ও সমুন্নত খেজুরগাছ, যার মধ্যে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর। (এগুলো) আমার বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ। বৃষ্টি দিয়ে আমি সঞ্জীবিত করি মৃত ভূমিকে। এভাবেই পুনরুত্থান ঘটবে। ’ (সুরা : ক্বফ, আয়াত : ৯-১১) হাদিস শরিফে চাষাবাদের গুরুত্ব মরুময় আরবে মহানবী (সা.) জন্মগ্রহণ করেছেন। তথাপি তাঁর বহু বাণী রয়েছে কৃষিকাজের গুরুত্বের ওপর। তাঁর এ হাদিসটি হয়তো অনেকেই জানেন, ‘যে মুসলমান কোনো বৃক্ষ রোপণ করে কিংবা বীজ বপন করে, তারপর তা থেকে কোনো পাখি, মানুষ বা চতুষ্পদ জন্তু ভক্ষণ করে, তাহলে এর বিনিময়ে তার জন্য একটি সদকার সওয়াব রয়েছে। ’ (বুখারি শরিফ, হাদিস : ২১৩৭; মুসলিম শরিফ, হাদিস : ১৫৫৩) এ হাদিসটি আরো স্পষ্ট করে অন্য জায়গায় বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষ রোপণ করে, আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তাকে ওই বৃক্ষের ফলের সমপরিমাণ প্রতিদান দান করবেন। ’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৩৫৬৭) চাষাবাদ ও বৃক্ষরোপণ সম্পর্কে অত্যন্ত চমত্কার একটি হাদিস আছে। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কারো হাতে ছোট একটি খেজুরগাছ থাকা অবস্থায় যদি কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যায়, তাহলে সে যেন গাছটি রোপণ করে দেয়। ’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১২৯০২; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৪৭৯; মুসনাদে বাজজার, হাদিস : ৭৪০৮) ইসলামী শরিয়তের মূলনীতি হলো, কেউ রাষ্ট্রীয় অনাবাদি জমি আবাদ করলে তার মালিক হয়ে যায়। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন কোনো জমি আবাদ করে, যা কারো মালিকানায় ছিল না, তাহলে সে ওই জমির (মালিক হওয়ার) বেশি হকদার। ’ (বুখারি, হাদিস : ২৩৩৫) নিজে চাষাবাদ না করলে অন্যকে সুযোগ দেওয়া উচিত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার কাছে জমি আছে, সে যেন তা নিজে চাষ করে, অথবা তার ভাইকে দিয়ে দেয়। যদি এটাও না করতে চায়, তাহলে সে যেন তার জমি ফেলে রাখে। ’ (বুখারি, হাদিস : ২২১৬; মুসলিম, হাদিস : ১৫৩৬) চাষাবাদ করতে হলে যেতে হবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তাই মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ভূমির খনিতে বা লুক্কায়িত অংশে রিজিক অন্বেষণ করো। ’ (মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদিস : ৪৩৮৪) ইসলামে কৃষিকাজ ও চাষাবাদের প্রতি এতই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে যুদ্ধের সময়ও যেন ক্ষেতখামার নষ্ট না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে বলা হয়েছে। হজরত আবু বকর (রা.) তাঁর শাসনামলে সিরিয়ায় যখন সৈন্য বাহিনী পাঠান, তখন তিনি তাদের প্রতি এ নির্দেশ জারি করেন—‘তোমরা কিছুতেই কোনো ফলবান বৃক্ষ কাটবে না। ’ (মুআত্তা ইমাম মালেক, হাদিস : ৯৬৫; তিরমিজি, হাদিস : ১৫৫২) কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নজির স্থাপন করেছেন হজরত ওমর (রা.)। ইমাম আবু ইউসুফ (রা.) তাঁর প্রখ্যাত ‘কিতাবুল খারাজ’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘এক কৃষক ওমর (রা.)-এর কাছে অভিযোগ করেছেন, হে আমিরুল মুমিনিন, আমি চাষাবাদ করেছি। সিরিয়াগামী মুসলিম সৈন্যদল এই ক্ষেতের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে। আর (অতিক্রমের মাধ্যমে) তারা ওই ক্ষেত ধ্বংস করে দেয়। এ কথা শুনে হজরত ওমর (রা.) ক্ষতিপূরণস্বরূপ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ১০ হাজার দিরহাম দিয়ে দেন। ’ (কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ১২৯) ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রযুক্তিতে মানুষ যতই উত্কর্ষ সাধন করুক না কেন, চাষাবাদ ছেড়ে দিলে জীবনযাত্রা সংকুচিত হয়ে যাবে। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (রহ.) এ বিষয়ে লিখেছেন, ‘দেশের বেশির ভাগ নাগরিক যদি বিভিন্ন পেশা ও দেশীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে যায় এবং তারা যদি পশু পালন ও চাষাবাদে কম অংশগ্রহণ করে, তাহলে জাগতিক জীবনে ওই জাতির অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়বে। ’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা : ২/১০৫) পবিত্র কোরআন ও হাদিসের উল্লিখিত প্রমাণাদির আলোকে ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রতিটি দেশের মানুষের নির্দিষ্ট অংশের জন্য চাষাবাদ করা ফরজ। এ বিষয়ে ফতোয়া হলো, ‘যৌথ বা ব্যক্তিগতভাবে চাষাবাদ করা ফরজে কিফায়া। কেননা এতে মানুষ ও প্রাণীর (জীবনধারণের) প্রয়োজন আছে। ’ (আল-ফিকহ আলাল মাজাহিবিল আরবাআ : ৩/১২)পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)। তাঁর সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছে, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি তোমাদের আদম (আ.) সম্পর্কে বলব। তিনি কৃষিকাজ করতেন। ’ (মুসতাদরাক হাকেম, হাদিস : ৪১৬৫) হাজারো নবীর পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)। তাঁর সম্পর্কে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি তোমাদের ইবরাহিম (আ.) সম্পর্কে বলব। তিনি চাষবাস করতেন। ’ (মুসতাদরাক হাকেম, হাদিস নম্বর-৪১৬৫)
Post Top Ad
Responsive Ads Here
Thursday, February 1, 2018
ইসলামের দৃষ্টিতে কোরআন ও হাদিসে চাষাবাদের গুরুত্ব
Post Top Ad
Responsive Ads Here
Author Details
Templatesyard is a blogger resources site is a provider of high quality blogger template with premium looking layout and robust design. The main mission of templatesyard is to provide the best quality blogger templates which are professionally designed and perfectlly seo optimized to deliver best result for your blog.